আজ বাংলা চলচ্চিত্র জগতের দিকপাল, বিশিষ্ট আবৃত্তিকার, মহান কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। বয়সে ৮৫-তে পা দিলেও, মনের দিক থেকে আজও তিনি আঠারোর সেই টগবগে যুবক। মন সর্বদা সৃষ্টিশীলতায় মশগুল। অনুভব করে চলেছেন জীবনের প্রতিটি ক্ষণ আনন্দের সাথে। নিজেকে ছুঁয়ে দেখেন বারবার ভালোবাসার মাঝে। ভারতীয় সিনেমা জগতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। দশকের পর দশক ধরে তিনি বিভিন্ন ধরনের ছবি উপহার দিয়ে চলেছেন চলচ্চিত্র প্রেমীদের। তাঁর অসাধারন অভিনয়ের জাদুতে বছর এর বছর ধরে সিনেমার প্রতি আকর্ষন সৃষ্টি করেছে চলচ্চিত্র প্রেমীদের। ৬০ বছরের ওপর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবন। করেছেন ৩০০-রও বেশি ছবি। অভিনয় ছাড়া তিনি নাটক ও কবিতা লিখেছেন, নাটক পরিচালনা করেছেন। তিনি একজন খুব উচ্চমানের আবৃত্তিকারও বটে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আদি বাড়ি বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহ। তবে পিতামহের আমল থেকেই তাঁদের পরিবার পশ্চিম বঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে স্থায়ীভাবে বসতি গড়েন। সে বাড়িতেই অভিনেতার জন্ম। কৃষ্ণনগরের সেন্ট জন্স স্কুলে তার পড়াশোনায় হাতেখড়ি। জীবনের প্রথম দশটা বছর সৌমিত্র কাটিয়েছিলেন কৃষ্ণনগরে। দাদুর নাটকের দল ছিল। বাবা পেশায় উকিল।বাবার কর্মস্থল পরিবর্তনের সাথে সাথে বদল হতে থাকে স্কুল। হাওড়া জেলা স্কুলে মাধ্যমিক শেষ করেন। এরপর কলকাতার সিটি কলেজ থেকে আইএসসি আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বি এ অনার্স সম্পন্ন করেন। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টসেও দু বছর পড়াশোনা করেন তিনি। ছোট থেকে থিয়েটার ভাল লাগত… স্কুল, কলেজে পড়ার সময় অনেক নাটক করেছেন। কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতায় চলে আসার পর সে শখ আরও তীব্র হতে থাকে। শখ ছিল, তবে অভিনয়কেই পেশা করবেন কখনও ভাবেননি। একটা নাটক দেখতে গিয়ে জীবনটা কেমন বদলে গেল। শিশির ভাদুড়ির নাটক। সেই নাটকে শিশির ভাদুরির অভিনয় দেখে সৌমিত্র স্থির করলেন পেশাগত ভাবে অভিনয় করবেন। চেষ্টা চরিত্র করে শিশির ভাদুরির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, প্রশিক্ষণ নিলেন। দ্বিতীয়বার জীবনে মোড় ঘোরে যখন তিনি সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু’ হলেন। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর মানিকবাবুর সেটে প্রায়ই যেতেন। ‘জলসা ঘর’-এর শ্যুটিং চলছে, রোজকার মতো সেটে গিয়েছেন সৌমিত্র। বাড়ি ফেরার সময় মানিকবাবু তাঁকে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে আলাপ করালেন। বললেন, সৌমিত্র তাঁর ছবির ‘অপু’! চমকে যান তিনি… এই আশাতেই হয়তো রোজ আসতেন… স্বপ্ন বাস্তব হয়ে যাওয়ায় অবাক হন সৌমিত্র। ১৯৫৯ সালে সত্যজিত রায় -এর অপুর সংসার ছবির হাত ধরে সেই শুরু হল পথচলা। ছবিটি পরিচালকের ৫ম চলচিত্র পরিচালনা। তিনি এর আগে রেডিয়োর ঘোষক ছিলেন এবং মঞ্চে ছোটো চরিত্রে অভিনয় করতেন। ধীরে ধীরে তিনি সত্যজিত্ রায়ের সঙ্গে ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। তিনি সত্যজিত রায় নির্মিত বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হন।অপু ট্রিলজি, ফেলুদা সিরিজ থেকে শাখা প্রশাখা…সত্যজিৎ তাঁকে মাথায় রেখেই যেন চিত্রনাট্য লিখতেন। মৃণাল সেন এবং তপন সিনহার সঙ্গে বেশ কিছু ভাল ছবি রয়েছে সৌমিত্রর। উত্তম বনাম সৌমিত্র, এই তর্ক বাঙালি করে এসেছেন চিরকাল। তবে এই দুই প্রথম সারির নায়ক, বাস্তব জীবনে ছিলেন বেশ ভাল বন্ধু। সৌমিত্রর বনের বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে আসেন উত্তমকুমার। সেখানে প্রথম আলাপ। তারপর উত্তমবাবুর ব্যক্তিগত আড্ডার আসরে ডাক পেতেন সৌমিত্র। ঝিন্দের বন্দির আউটডোরে হয়ে গেল দারুণ বন্ধুত্ব। উত্তমকুমার হয়ে উঠেলেন তাঁর অভিভাবক। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলোর ভিতরে সবথেকে জনপ্রিয় হল ফেলুদা । তিনি সত্যজিত রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। প্রথমে ফেলুদা চরিত্রে তার চেয়েও ভালো কাউকে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তার অভিনীত ফেলুদার প্রথম ছবি সোনার কেল্লা বের হওয়ার পর সত্যজিত রায় স্বীকার করেন যে, তার চেয়ে ভালো আর কেউ ছবিটি করতে পারতনা। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি তিনি। সুচিত্রা সেন, অপর্ণা সেন, মাধবী মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, লিলি চক্রবর্তী, মমতাশঙ্কর হয়ে রাধিকা আপ্তে, মিমি চক্রবর্তী, ইন্দ্রাণী হালদার, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, গার্গী রায়চৌধুরীর সঙ্গে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র বাবু।এই উপমহাদেশে যে ক’জন অভিনেতা মেধায় আর সাবলীলতায় অভিনয়কে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায় তাদের মধ্যে অন্যতম একজন চির তরুণ নায়ক তিনি। স্বনামধন্য অভিনেতা ভূষিত হয়েছেন দেশি-বিদেশি অসংখ্য সম্মানে। ফ্রান্স সরকারের কাছ থেকে সে দেশের শিল্পের সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অফ আর্টস এন্ড লেটার্স’ লাভ করেন। ইতালি সরকার প্রদান করেছে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভম্যান্ট’। ভারতের কাছ থেকে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে বঙ্গবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করে। পেয়েছেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মান দাদাসাহেব ফালকে। অভিভাবক সৌমিত্রের শুভজন্মদিনে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছেন টলিউড অভিনেতা দেব। সম্প্রতি ‘সাঁঝবাতি’ ছবিতে তাঁদের এক সঙ্গে অভিনয় করতে দেখা গেছে। এই ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-কে দেব ছানা দাদু বলে ডাকতেন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তাতেও দেব লিখেছেন, ‘শুভ জন্মদিন ছানা দাদু’। আজ তাঁর জন্মদিনে টেলি সিনে-র বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য।
শুভ জন্মদিন ছানা দাদু 🙏🏻😘 pic.twitter.com/8AwngaDz7g
— Dev (@idevadhikari) January 19, 2020