আজ গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়-এর ৮৯তম জন্মদিন, রইল শ্রদ্ধার্ঘ্য

ভারত তথা বাংলার সঙ্গীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তাঁর কন্ঠের যাদুতে আজও মুগ্ধ সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ। আজ কিংবদন্তী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়-এর ৮৯তম জন্মদিন। ৪ অক্টোবর ১৯৩১ সালে কলকাতার ঢাকুরিয়াতে রেলের কর্মকর্তা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং হেমপ্রভা দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক এ টি ক্যানন এবং অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ীর নিকট তিনি সঙ্গীত প্রশিক্ষণ শুরু করেন। তবে তাঁর গুরু ছিলেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান, তাঁর পুত্র উস্তাদ মুনাওয়ার আলী খান, যার অধীনে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আয়ত্ত করেছিলেন। ১৯৪৪ সালে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সঙ্গীত জগতে আসেন । তাঁর প্রথম রেকর্ড,-‘তুমি ফিরায়ে দিয়াছ’ এবং ‘তোমার আকাশে ঝিলিমিলি করে’। ১৯৪২ সালে তিনি রেডিওতে গান গাওয়া শুরু করেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ষোলো । গানটি ছিল ‘যদি বা ফুরালো গান’। সিনেমায় প্রথম গান করেন ১৯৪৮ সালে ‘অঞ্জন গড়’ ছবিতে । সেই রাইচাঁদ বড়ালের যুগ থেকে এ যুগের সুমনের সুরে গানও করেছেন তিনি । তিনি এখনও পর্যন্ত ১০ হাজার গান গেয়েছেন, সব গানই তাকে খ্যাতি দিয়েছে । ১৯৫০সালে তারানা চলচ্চিত্রে একটি গান দিয়ে মুম্বাইতে হিন্দি গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। তিনি ১৭টি হিন্দি চলচ্চিত্রে একজন নেপথ্য গায়িকা হিসেবে গান গেয়েছিলেন। ব্যক্তিগত কারণে ১৯৫২ সালে তিনি কলকাতা শহরের বাড়িতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে অনুপম ঘটকের সুরে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে গান গেয়েছিলেন,-‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’। এ গান শুনলে বৃদ্ধরাও যৌবনে চলে যেতে চান । তার নামটিই যেন হৃদয়ে ঝঙ্কার তোলে । নামটির এমন মহিমা যে উচ্চারিত হলেই শ্রোতাদের মনের আকাশে এক লহমায় গানের ইন্দ্রধনু ফুটে ওঠে । ১৯৬৬ সালে তিনি বাঙালী কবি শ্যামল গুপ্তকে বিয়ে করেন। ১৯৭০ সালে জয় জয়ন্তী এবং নিশি পদ্ম চলচ্চিত্রে তার গানের জন্য সেরা নেপথ্য গায়িকার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণ পান তিনি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়-এর নাম শুনলেই গানের ঢেউ,-‘মায়া’ ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’, ‘মধুমালতী ডাকে আয়’, ‘বকম বকম পায়রা’, ‘এ গানে প্রজাপতি’, ‘নতুন সূর্য আলো দাও’, ‘ওগো মোর গীতিময়’, ‘চন্দন পালঙ্কে শুয়ে’, ‘মধুর মধুর বংশী বাজে’, এমনি অসংখ্য গান সঙ্গীত শ্রোতাদের মন বিস্মৃত করে স্মৃতির কুয়াশা । বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে আছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় । হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-এর সঙ্গে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়-এর জুটি ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। হেমন্ত ও সন্ধ্যা বাংলার মহানায়ক উত্তম কুমার এবং তার অসংখ্য নায়িকা জোড়াগুলির নেপথ্য কণ্ঠস্বর হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের কণ্ঠে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-এর রচনা ছাড়াও রবিন চট্টোপাধ্যায় ও নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে তিনি অনেক কাজ করেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মানেই হেমন্ত-সন্ধ্যা, অনুপম-সন্ধ্যা, রবীন-সন্ধ্যা, মানবেন্দ্র-সন্ধ্যা, মান্না-সন্ধ্যা, শ্যামল গুপ্ত-সন্ধ্যা, সুচিত্রা-সন্ধ্যা-এমন বহু উজ্জ্বল অধ্যায় ভরে আছে তাঁর শিল্পী জীবনে । ঠিক এভাবেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় লিজেন্ড হয়ে থাকবেন চিরকাল সঙ্গীতপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায় । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে আগত লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি ভারতীয় বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে গণ আন্দোলনে যোগ দেন এবং তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশী সংগীতশিল্পী সমর দাস যিনি বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন তার সাহায্যার্থে বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান রেকর্ড করেন। কারাগারে বন্দী নতুন বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির উপলক্ষে তার গাওয়া ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে’ গানটি মুক্তি পায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারির উদযাপন উপলক্ষে ঢাকায় পল্টন ময়দানের একটি উন্মুক্ত কনসার্টে অনুষ্ঠান করা তিনি অন্যতম প্রথম বিদেশি শিল্পী। আজ কিংবদন্তী এই সঙ্গীতশিল্পীর জন্মদিনে টেলি সিনে-এর পক্ষ থেকে রইল শ্রদ্ধার্ঘ্য। আমরা তাঁর সুস্থতা এবং দীর্ঘায়ু কামনা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *