রাজ্যে শান্তি বজায় রাখার বার্তা দিলেন বিশিষ্টজনেরা

নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে দেশ জুড়ে জ্বলছে অশান্তির আগুন। অসম-ত্রিপুরার পর তার জের থেকে রেহাই পায়নি পশ্চিমবাংলাও। একপ্রকার তাণ্ডব চলছে রাজ্যজুড়ে। প্রতিবাদের জেড়ে অগ্নিগর্ভ কোনা এক্সপ্রেসওয়ে, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা। একের পর এক জ্বলছে বাস। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে গিয়ে আক্রান্ত পুলিশ। কার্যত স্তব্ধ জনজীবন। চূড়ান্ত ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ। অশান্তি আঁচ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না রোগী-সহ অ্যাম্বুল্যান্সে সওয়ারিরাও। প্রতিবাদের নামে প্রতিবাদের ভাষা বদলানোর আবেদন জানিয়েছেন বাংলার বিশিষ্টজনেরা। CAB (Citizenship Amendments Bill)-এর বিরোধিতায় ঘটনার জেরে সাধারণ মানুষকে শান্ত থাকার আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর সুর টেনেই মন্তব্য করেছেন বুদ্ধিজীবীরা। দিন কয়েক আগেই CAB-এর বিরোধীতা করে কেন্দ্রীয় সরকারে দরবারে চিঠি পাঠিয়েছিলেন অপর্ণা সেন, অরুন্ধতী রায়-সহ বহু বিশিষ্টজনেরা। রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন পরিচালক-অভিনেত্রী অপর্ণা সেন। তাঁর কথায়, “গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলন করুন। শান্তি বজায় রাখুন। ভাঙচুর নয়। যে কোনও ইস্যু চরমে পৌঁছলে হিংসাত্মক পথ নেয়, সে জায়গায় মাথা ঠান্ডা রেখে প্রতিবাদ করাই বুদ্ধিমত্তার। যেভাবে বাংলায় প্রতিবাদ হচ্ছে, তা সমর্থনযোগ্য নয়।” শান্তির আবেদনের পাশপাশি সরকারি সম্পত্তি নষ্ট না করারও অনুরোধ জানিয়েছেন অপর্ণা সেন। অপর্ণার সুর টেনে পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তও একই কথা বলেছেন- “এটা প্রতিবাদের পথ নয়। প্রতিবাদ সংযত হোক, হিংসাত্মক নয়। হিংসাত্মক পথে প্রতিবাদ হয় না। শান্তিপূর্ণ পথে প্রতিবাদ হোক। হিংসাত্মক প্রতিবাদে আরও খারাপ হয়। এই প্রতিবাদ কেউ ভালভাবে নিচ্ছেন না। সংযত প্রতিবাদ হোক।” সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ”ভিটে হারানোর ভয়ে মানুষ। বিশৃঙ্খল আন্দোলন উচিত নয়। এটা আন্দোলনের পথ নয়। শান্তিপূর্ণভাবেও প্রতিবাদ হয়। পশ্চিমবঙ্গবাসীকে সংযত হতে হবে। জোর করে আইন চাপানো উচিত নয়। তাঁর অভিমত, আইন জোর করে চাপানো উচিত নয়। এরকম বিশৃঙ্খল আন্দোলন মোটেই সমর্থন করা যায় না। দেশের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির অচলাবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে একহাত নিয়েছেন অভিনেতা তথা নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন। কৌশিকের কথায়, “গত কয়েকদিন ধরে যে পরিস্থিতি চলছে এবং ক্রমাগত আন্দোলন যে হিংসাত্মক পথ নিচ্ছে, এমনটা চলতে থাকলে আখেরে লাভ বিজেপি’রই হবে। আন্দোলনের এমন ভাষাকে বিশ্রী হিংসাত্মক চিত্র দিয়ে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করবে গেরুয়া দল। যে অশান্তিতে সুবিধে হবে ওদের।” উদ্বেগপ্রকাশ করে নাট্যকার রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলেছেন, “ট্রাম, বাস জ্বালালে আখেরে সাধারণ মানুষেরই বিপদ। আর এভাবে হিংসা-মারামারি কখনওই আন্দোলনে ভাষা হতে পারে না।” পরিচালক আবুল বাসারের কথায়, “প্রতিবাদকে সমর্থন করি। কিন্তু আন্দোলনের এই পথ সমর্থন যোগ্য নয়।” এই পরিস্থিতিতে কষ্ট পেয়েছেন বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব দেবশঙ্কর হালদার। শান্তি বজায় রাখার অনুরোধ করেছেন তিনি। ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তাঁর মনে। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি বিপন্ন-ভীত অনুভব করছেন। তাঁর মতে, ‘বিপন্নতা প্রকাশ করতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে ঢিল ছুঁড়লে, ভাঙচুর করলে, বাধ্য হয়ে ধ্বংসের পথ নিলে, উল্টোদিক থেকেও আক্রমণ হবে যা অভিপ্রেত নয়। এতে নিজেদের বন্ধুদেরই ক্ষতি হবে।’ তিনি বোঝেন একটা ক্ষত তৈরি হয়েছে। তবে তাঁর মতে, ‘ যন্ত্রণার মধ্যেই ক্ষত আঁচড়ালে আরও রক্তপাত হবে। বরং এমন কোনও উপশম খোঁজা প্রয়োজন যা ক্ষতের একেবারে উৎসে নিয়ে যাবে। সকলের উচিত, গণতান্ত্রিক পথে প্রতিবাদের রাস্তায় হাঁটা।’ দেবশঙ্কর হালদারের কথায়, যাঁরা পাশাপাশি মাঠে ময়দানে একসঙ্গে কাজ করেন, সেই নানান বর্ণের, নানান ধর্মের, নানান সম্প্রদায়ের মানুষ, তাঁরা যেন পরস্পরকে ভুল না বোঝেন। প্রতিবাদ বা বিক্ষোভের ফলে এমন কোনও পদ্ধতি তৈরি না হয়, যাতে পাশের মানুষকে হারিয়ে ফেলার অবস্থা তৈরি হয়। ভয়ের বাতাবরণ যেন তৈরি না হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *